আদর্শবাদী ব্লগার বনাম সৃজনশীল ব্লগার বনাম ফেইসবুকিং ব্লগার বনাম…

কেউ কেউ বলেন, ব্লগার সিজনাল, ব্লগ থাকে চিরকাল। পত্রিকার পাতায় প্রকাশিত লেখা দিনান্তে ভাঁজে পড়ে যায়, কিন্তু ব্লগের লেখা সব সময় থাকে পড়া ও উদ্ধৃতির জন্য প্রস্তুত। বই অথবা সংবাদপত্রের পাতা হারিয়ে যেতে পারে দৃষ্টিসীমানা থেকে, কিন্তু বোদ্ধারা বলেন, ইন্টারনেটে নাকি ইরেজার নেই! ওখানে কোন কিছুই মুছে যায় না। পোস্টদাতা মুছে দিলেও সেটি কোথাও-না-কোথাও থেকেই যায়।

ব্লগারদের মধ্যে একটি বড় অংশ আসে যুবসম্প্রদায়ের কর্মহীন ও স্টুডেন্ট অংশ থেকে। তারা ইন্টারনেটে এসে একটি সামাজিক বন্ধন সৃষ্টি করেন। ব্লগে যতদিন থাকেন চুটিয়ে ব্লগিং করেন: লেখায় প্যাশনেট, মন্তব্যে অনেস্ট। পোস্ট দেন, মন্তব্য দেন এবং এমনকি বিভিন্ন ব্লগারদের পোস্ট নিয়ে সংকলনও বের করেন। তারা নতুন পুরাতন সকল ব্লগারকে জাগিয়ে রাখেন, লেখায়-মন্তব্যে-সংকলনে। অল্পকাল স্থায়ি হলেও একটি ব্লগকে প্রাণচঞ্চল রাখতে এই ব্লগারদের রয়েছে বিরাট ভূমিকা। সকলেই সিজনাল ব্লগার নন। অনেকেই কর্মজীবনে গিয়েও ব্লগিং করছেন।

স্ট্যাটাস লেখতে লেখতে লেখক। ভাষার ভুল আর বানানের ভুল করার একচ্ছত্র অধিকার তারা ভোগ করেন! ব্লগে যদি ভুল না করা যায়, তবে আর কোথায়! আই ডোন্ট মাইন্ড দেয়ার ল্যাংগুয়েজ। নতুনেরা আদর্শ নিয়ে আসুন, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ নিয়ে আসুন অথবা দৈনিক স্ট্যাটাস নিয়ে আসুন, যত বেশি ব্লগে থাকেন ততই হয় সৃষ্টি। আজকের দিনের কোন টিনেজ বালিকার তাৎক্ষণিক একটি প্রতিক্রিয়া, অথবা পাঁচ লাইনের একটি স্ট্যাটাস, আগামি দশ বছর পর হতে পারে একটি ঐতিহাসিক ঘটনার নির্ভরযোগ্য সাক্ষী। অথবা একটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদের বিশ্বাসযোগ্য সূত্র। কে জানে!

আমি খুব চাই, ব্লগের সঞ্চালক যেন তাদেরকে কোনভাবেই নিরুৎসাহিত না করেন, অথবা থামিয়ে না দেন। দিনে একাধিক ততোধিক পোস্ট দিলেও না! সামুতে অবশ্য এই কথা বলে দিতে হয় না। ব্লগ হওয়া উচিত তরুণ প্রজন্মের উচ্ছ্বাসে ভরা হইহুল্লাপূর্ণ এক আড্ডাখানা। এখান থেকে বের হয়ে আসুক ভবিষ্যত সমাজের নেতৃত্ব ও মননশীলতার পথনির্দেশ। কিন্তু জীবন ও জীবিকার অদম্য আকর্ষণে তাদেরকে যেতেই হয়। মজার ব্যাপার হলো, পেশা যা-ই হোক ব্লগার নামটি অন্তর থেকে মুছে ফেলেন না তারা! হয়তো তা সম্ভবও হয় না!

২.
বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক কারণে ‘বাংলাদেশ’ আর অধিকাংশ তরুণের নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হতে পারে না
। কাজ অথবা বিদ্যালাভের জন্য তারা স্বদেশ ছাড়েন এবং অধিকাংশই (স্থায়ীভাবে) ফেরেন না। কিন্তু স্বদেশকে ভুলে থাকতে পারেন না – বরং দূরত্বের বেদনায় তীব্র স্বদেশপ্রেমে আপ্লত থাকেন অনেকে। গণমাধ্যমে স্বদেশের সংবাদ নেন, সংবাদ বিশ্লেষণ করেন ও অভিমত দেন। ফেইসবুক, টুইটার, ব্লগ ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমে তারা দেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ঘটনাবলীতে জড়িয়ে থাকার চেষ্টা করেন। নিজ দেশের মানুষের সাথে আকাশপথে পরিচিতি গড়ে তোলেন। দূরে থেকেও স্বদেশের আকর্ষণ নতুনভাবে উপলব্ধি করেন।

বলছি প্রবাসী ব্লগারদের কথা। তাদের মধ্যে অনেকের নিকনেইম আজ কিংবদন্তি লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠিত সংবাদমাধ্যমে গুরুত্বের সঙ্গে ছাপে তাদের লেখা। (কেউ আবার বিদেশী নাগরিকত্ব বা দূরত্বের সুবিধা নিয়ে একটু একটু বাড়তি কথা বলার সুযোগ নিয়ে থাকেন। অপমানজনক, দেশপ্রেমহীন এবং দায়িত্বহীন মন্তব্য দিয়ে থাকেন বিভিন্ন স্পর্শকাতর বিষয়ে, যা হয়তো স্বদেশে থাকলে সাহস করতেন না।) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে থাকা বাংলাভাষী ব্লগাররা ব্লগকে চব্বিশ ঘণ্টা মাতিয়ে রাখেন। ফটোপোস্ট, ভ্রমণ পোস্ট এবং প্রবাসী জীবনের লেখা দিয়ে সমৃদ্ধ করে চলেছেন বাংলা ব্লগকে। ফলে ব্লগ হয়েছে মেধাবী তরুণদের স্বদেশে ফেরার প্রেরণা। জয়তু প্রবাসী ব্লগার!

৩.
ব্লগ লেখার প্রেরণা আসে ‘ব্লগারের উদ্দেশ্য’ থেকে।
তার উদ্দেশ্য যদি হয় কোন আদর্শকে প্রতিষ্ঠা করা, তবে লেখায় থাকে যুক্তি ও তথ্যের সম্মিলন। এখানে নতুন/পুরাতন বলে কোন কথা নেই। তিনি প্রবন্ধ লেখছেন, নাকি নিবন্ধ লেখছেন, নাকি কবিতা লেখছেন – কিছুই যায় আসে না। লেখার মূল বক্তব্যে থাকে আদর্শের প্রতিচ্ছবি। আদর্শবাদী ব্লগাররা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্য হতে আসেন এবং তুলনামূলকভাবে বেশিদিন টেকেন। এঁরা ব্লগের বটবৃক্ষ! অতীত ও ভবিষ্যৎ ব্লগারদের মধ্যে যুগবন্ধনকারী। ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের প্রতিচ্ছবি। ব্লগে তাদের মন্তব্য সাধারণত শ্লেষপূর্ণ ও প্রতিক্রিয়াশীল হয়।

বলাবাহুল্য, প্রতিক্রিয়াশীলতা পুরোপুরি নেতিবাচক কোন বিষয় নয়। বিপ্লব ও সংস্কারের তাড়না আসে প্রতিক্রিয়াশীলতা থেকে। দেশের প্রচলিত আইন ও সার্বভৌমত্বকে অক্ষুণ্ন রেখে পরিবর্তনের কথা বলা কোন অপরাধ নয়। বাংলা ব্লগের শুরুর সময়টি ছিল আদর্শবাদী ব্লগারদের সোনালি দিন। বর্তমান সময়টিও ফেলনা নয়, তবে সোনালি রুপালি ইত্যাদি ‘রঙ’ দিয়ে এখন আর ব্যাখ্যা করা যায় না!

যা হোক, আদর্শবাদী ব্লগাররা কিন্তু ব্লগের ‘হিট লক্ষ্ণী’। মন্তব্য ১টি, পঠিত ১১,২৮৮বার! অথবা তিন লাইনের একটি লেখায় দেখবেন মন্তব্য পড়েছে মাত্র ৩০২টি! (অবশ্য, ট্যাগিং, বিভক্তি সৃষ্টি এবং দেশের হারিয়ে যাওয়া ও গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ‘অবহেলিত গালিগুলোকে’ একত্রিত করে সেগুলোকে বহুলপ্রচলিত ও জনপ্রিয় করার কাজে কিছু ব্লগারের অবদান অনস্বীকার্য।)

জাতীয় এবং সামাজিকভাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুাতে জনমত সৃষ্টি করা এবং কর্তৃপক্ষকে ভালো সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করেছেন এশ্রেণীর ব্লগাররা। নতুন প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ধারণা সৃষ্টি এবং জাতীয়তাবাদের ভিত মজবুত করে চলেছেন তারা। নাগরিক সাংবাদিকতার মাধ্যমে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যার সমাধানে সৃষ্টি করেছেন ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা।

৪.
ব্লগ যেন সৃজনশীলতার চারণভূমি! এখানে সৃজনশীলতা পয়দা হয়!
তাৎক্ষণিক প্রকাশ, তাৎক্ষণিক মন্তব্য আর অভিমতের সুযোগ নিয়ে অনেক স্ট্যাটাস লেখক জীবনমুখী গল্পকার, ছড়াকার বা কবিতে পরিণত হয়েছেন। কেউবা হয়েছেন বিবর্তিত! নাকি মেটামরফোসিস? ছিলেন কবি, হয়েছেন গল্পকার; অথবা ছিলেন ডাক্তার, হয়েছেন কবি! (কেউ কেউ লেখতে লেখতে আরও ভোঁতা হয়েছেন। কিছুই হতে পারেন নি/হন নি, বরং যা ছিলেন, তা হারাবার দশা হয়েছে! নেভার মাইন্ড, তাদের সংখ্যা এতই কম যে খালি চোখে দেখা যায় না!)

ঠিক ব্যাখ্যা করতে পারবো না, কিন্তু ব্লগ থেকে সৃষ্ট লেখকেরা যেন ‘ভিন্ন একটা জেনার’ সৃষ্টি করছেন বাংলা সাহিত্যে। প্রথাগত গ্রন্থকারদের সাথে তাদেরকে পুরোপুরি মেশানো যায় না। তাতে ব্লগারদেরই লস হবে। (অন্যদিকে কেউবা হয়েছেন বনসাঁই – বয়স বাড়লেও অন্যকিছু বাড়ে নি। বছরের পর বছর লেখেও ‘জাতীয়’ বানান লেখতে পারেন না। প্রচলিত শব্দগুলোকে না জেনেই নতুন শব্দগঠনে নামেন। আর, কবিতার কী ছিরি! যাক, এসব বিষয় তত ব্যাপক নয়।)

সৃজনশীল ব্লগাররা ব্লগের সাহিত্য সম্ভারকে গড়ে তুলেছেন। সৃজনশীলেরা একদিনে তৈরি হয় নি। পরিশ্রম, একনিষ্ঠতা, অধ্যয়ন ও জীবনবোধ হলো সৃজনশীল ব্লগারদের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কেউ ব্লগার হয়ে লেখক হয়েছেন, কেউবা আগেই লেখক ছিলেন। তবে ব্লগে প্রথম শ্রেণীর লেখকের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু সকলেরই আদি এবং অন্ত ব্লগ। এঁরা সৃজন করেন। নামের কারনেই সৃজনশীলদের নাম অনেক ওপরে!

ব্লগারদের সংখ্যা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। কেউ বলছেন বেড়েছে, কেউ বলছেন কমেছে। জনসংখ্যা আর ইন্টারনেট ইউজার যদি বাড়ে, তবে ব্লগারের সংখ্যা কমে কীভাবে? আমি বলছি, দু’টোই হয়েছে। বেড়েছে ব্লগার এবং ব্লগসাইট; কমেছে প্রতি ব্লগসাইটের নিজস্ব ব্লগারের সংখ্যা। সব মিলিয়ে একটি বৃহৎ ব্লগার কমিউনিটি গড়ে ওঠেছে বাংলা ভাষায়। সংবাদ মাধ্যমের কোন বিষয়ে সন্দেহ বা বিভ্রান্তি থাকলে মানুষ ব্লগে তাকায়, ব্লগের পৌনপুনিক দাবিগুলো অবশেষে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমে গড়ায়। কারও অধিকার ক্ষুণ্ন হলে উভয়ে (অনলাইন ও অফলাইন) সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে। ব্লগার এবং সামাজিক মাধ্যমের বলিষ্ঠ অংশগ্রহণ নিয়ে বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম একটি বৃহৎ ও শক্তিশালী গণমাধ্যম।

২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:০৭ [Somewhereinblog.net]

5 comments

  1. পিংব্যাকঃ ব্লগ ফেসবুক সহ ভার্চুয়াল মাধ্যমে লেখালেখি করে সাহিত্যের মূল স্রোতে কি মিশতে পারছেন অনলাইন লেখক
  2. পিংব্যাকঃ ব্লগ ফেসবুক সহ ভার্চুয়াল মাধ্যমে লেখালেখি করে সাহিত্যের মূল স্রোতে কি মিশতে পারছেন অনলাইন লেখক
  3. পিংব্যাকঃ ব্লগ ফেসবুক সহ ভার্চুয়াল মাধ্যমে লেখালেখি করে সাহিত্যের মূল স্রোতে কি মিশতে পারছেন অনলাইন লেখক

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান