সক্রেটিসের হেমলক পান এবং নিজেকে চেনা
বিচারের শেষ মুহূর্তে শাস্তি এড়াতে না পারলেও মৃত্যুদণ্ডকে এড়াতে পারতেন সক্রেটিস। তখন এথেন্সের বিচার ব্যবস্থায় অপরাধ চিহ্নিত হবার পর অপরাধীকে জিজ্ঞেস করা হতো, সে কী শাস্তি চায়। পাঁচশ’ জুরির উপস্থিতিতে সক্রেটিসকেও জিজ্ঞেস করা হলো, তিনি কী শাস্তি চান। কিন্তু যেহেতু তিনি নিজেকে অপরাধী মনে করতেন না, তার আচরণ ছিলো স্বভাবসুলভ অনমনীয়। তিনি শাস্তির পরিবর্তে পুরস্কারের প্রস্তাব করেন! উদ্বেগহীন সক্রেটিস প্রস্তাব করলেন, প্রাইটেনিয়াম হলে (পাবলিক হল) তাকে নিয়ে যেন বিশেষ এক ভোজের আয়োজন করা হয়। এটি প্রথাগতভাবে গ্রীসের বীরদের জন্য করা হতো। তাই জুরিরা ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন এবং বিপক্ষের জুরি সংখ্যা হঠাৎই ২৮০ থেকে ২২০ এ ওঠে গেলো। বিচার নিয়ে ঠাট্টাকারী সক্রেটিসের জন্য কঠিন শাস্তির প্রস্তাব আসলো।মৃত্যুদণ্ড বা শাস্তি নিয়ে সক্রেটিসের উদাসীনতার এখানেই শেষ নয়। শিষ্য আর বন্ধুরা মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত সক্রেটিসের জন্য মৃত্যুদণ্ডের পূর্ব পর্যন্ত এক মাস পেরোলে মুক্ত রাখার আবেদন করেছিলেন। তাতে আদালত মুক্তিপণ হিসেবে ৩০০০ দ্রাকমা (রৌপ্যমুদ্রা) দাবী করে, কিন্তু সক্রেটিস মাত্র ১০০ দ্রাকমা দিতে রাজি হন। অতএব জেলেই থেকে গেলেন দণ্ডপ্রাপ্ত সক্রেটিস। ওদিকে সময় হয়ে এলো হেমলক পানের।
সক্রেটিসের সময়ে শিষ্য, বন্ধু এবং পরিবারের সদস্যরা নিয়মিত জেলে আসতে পারতো এবং থাকতে পারতো। অবশ্য সাথে প্রহরীরাও থাকতো ছায়ার মতো।
মৃত্যুর দিনের সন্ধ্যাবেলার দৃশ্য। সক্রেটিস তার শিশুপুত্র মিনেজেনাস কে বললেন, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। স্বাভাবিকভাবে হাসিখুশি এবং শান্ত সক্রেটিস। তাকে ঘিরে বসে আছেন তার ভক্ত শিষ্য ও বন্ধুরা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরেই তাদের গুরুর মৃত্যুর দৃশ্য মঞ্চায়িত হবে। সাক্ষী হতে হবে এক অনাকাঙিক্ষত মৃত্যুর। শিষ্যরা সকলেই হতাশা আর আসন্ন বিচ্ছেদের বেদনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। ওদিকে সক্রেটিস তার মৃত্যুর পরের পোশাক গোছানো নিয়ে ব্যস্ত। তিনি পড়ে নিচ্ছেন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার পোশাক, কারণ তিনি চান না মৃত্যুর পর কেউ তার গায়ে হাত দিক। শিষ্য আর বন্ধুদের কাছ থেকে কিছু সময় আলাদা হয়ে পরিবারের সকলের সাথে কথা বলে নিলেন।
জেল কর্মকর্তা একটু সময় আগে শেষ বিদায় জানিয়ে গেলেন। তার দু’চোখ ছিলো অশ্রুতে পূর্ণ। তিনি বলে গেলেন যে, সক্রেটিস ছিলেন তার অভিজ্ঞতায় শ্রেষ্ঠ আসামি, সবচেয়ে ভদ্র আর অসম্ভব সাহসী। কিছুক্ষণ পরই হেমলকের রসে পূর্ণ পাত্র নিয়ে প্রবেশ করলো জল্লাদ। তীব্র এই হেমলক হৃদপিণ্ডে গিয়ে পৌঁছে নিমিষে শরীরকে অসাড় করে দেয়। জল্লাদ নিরাবেগ কণ্ঠে বললো, এই পাত্রে এক ফোঁটা হেমলকও যেন বাইরে না পড়ে! সবটুকু পান করতে হবে! সক্রেটিস জল্লাদকে নিশ্চয়তা দিয়ে বললেন, একটি ফোঁটাও নষ্ট হবে না। তারপর তিনি কিছুক্ষণ প্রার্থনা করলেন। রুদ্ধনিঃশ্বাসে সকলেই তাকিয়ে আছে সক্রেটিসের উদ্বেগহীন শান্ত মুখটির দিকে। মানসিকভাবে সকলেই অস্থির, একমাত্র সক্রেটিস ছাড়া।
প্রার্থনা শেষ করে বিষের পাত্র তুলে নিলেন সত্তর বছরের সক্রেটিস। পান করে নিলেন সবটুকু হেমলক রস, এক নিঃশ্বাসে। বিকৃত মুখভঙ্গি দেখলেই বুঝা যায় কেউ বিষ পান করছে, কিন্তু সক্রেটিসকে দেখে তা বুঝার উপায় নেই। তার মুখ বিন্দুমাত্র বিকৃত হয় নি। জলপানের মতো পান করেছিলেন তিক্ত বিষ। উপস্থিত সকলে উচ্চস্বরে কাঁদতে লাগলেন। একজন শিষ্য মৃগীরোগীর মতো কাতরাচ্ছিলেন। সক্রেটিস তাকে কোলে নিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে সুস্থ করলেন।
পাষণ্ড জল্লাদ এবার দিলো তার নিষ্ঠুরতম নির্দেশটি। জল্লাদ বললো, এবার সক্রেটিসকে কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করতে হবে যেন বিষটুকু ভালোভাবে সমস্ত শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। শিউরে ওঠে শিষ্যরা না না ধ্বনিতে মুখর করে তুললো জেলকক্ষটি। ভাবলেশহীন সক্রেটিস তা-ই করলেন। নিজের জীবনের বিনিময়েও তিনি জল্লাদের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা দিতে চান। তিনি ওঠে পায়চারি করতে লাগলেন। একসময় নিস্তেজ হয়ে এলো তার পা যুগল। অসাড় হয়ে এলো তার বিশালাকৃতির শক্ত দেহখানি। নিজের হাতেই মুখ ঢেকে শুয়ে পড়লেন তিনি। এবার সবাই শান্ত, একটি শব্দও নেই কারও মুখে। কিছুক্ষণ সবই নিশ্চুপ, শান্ত।
হঠাৎ মুখ থেকে কাপড় সরিয়ে সক্রেটিস বললেন, ক্রিটো, একটি মুরগি ধার করেছিলাম আমাদের পরিবারের জন্য। মনে করে তা আসক্লিপিয়াসকে শোধ করে দিও। এই তার শেষ বাক্য, যেন শেষ মুহূর্তে নিজেই নিজের বিচার করছিলেন। তারপর সবকিছু আবারও নিশ্চুপ। আর কোন শব্দ হয়নি।
ভেবে পাই না, জীবনটা কতটুকু শুদ্ধ হলে ‘চিটাগং যাবার মতো করে’ দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়া যায়। সক্রেটিস সম্পর্কে জানতে গিয়ে নিজের জীবন সম্পর্কে শুধু প্রশ্নেরই সৃষ্টি হলো!
.
.
সূত্র: প্লেটো’র ‘এপোলজি’ এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত ‘বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার’।
আমার খুব প্রিয় একজন মানুষ। তাকে যতই জানছি ততই অবাক হচ্ছি!
LikeLike
প্রিয় আম্মানসুরা, আপনার সাথে পরিচয় হওয়া আমার জন্যও এক বিশাল পাওয়া। সেদিন কথা বলে অনেক ভালো লেগেছে। দয়ালু মন্তব্যের জন্য অশেষ কৃতজ্ঞতা।
LikeLike
এই ভাবে প্রশংসা করলে আমি বিশ্বের সেরা মুটকির খাতায় নাম লিখেয়ে ফেলব!
দয়ালু মন্তব্য মানে কি?
LikeLike
আপনার মন্তব্যে বেশ শক্তি পেলাম। বয়স বাড়ছে, ব্যস্ততা বাড়ছে – শক্তির আধারগুলো থেকে ঠিকমতো সরবরাহ পাই না 😉
দয়ালু মানে হলো ‘কাইন্ড’! এ শব্দটিই প্রথমে মাথায় এসেছিলো, কিন্তু যথোপযুক্ত বাংলা মনে পড়লো না।
আপনি তাতে অসন্তুষ্ট হলে, আবার যোগাযোগের সময় জানিয়ে দেবেন!
অনেক শুভেচ্ছা, আম্মানসুরা আপনার জন্য 🙂
LikeLike
Sotee sir golpo te pora amar mona onak prosno jagca…..
LikeLike
ধন্যবাদ অনুপম। ভালো থাকুন 🙂
LikeLike